পথের ধুলোয় বেড়ে ওঠা,পড়াশোনা শেখেনি,সেই ছেলেই আজ ৯ হাজার গৃহহীন মানুষের আশ্রয়

পথের ধুলোয় বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা শেখেনি, সেই ছেলেই আজ ৯০০০ গৃহহীন মানুষের আ২০১২ সালের কথা, রাষ্ট্রপতি ভবনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে এক যুবক। মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মঞ্চের উপর আলো আর মিডিয়ার ভিড়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে সে।

পুরস্কার হাতে তুলে দিয়ে যেই প্রণববাবু যুবকের কাঁধে হাত রেখেছেন, স’ঙ্গে স’ঙ্গেই যেন ভেঙে গেল ধৈর্যের বাঁধ, চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়লো জল। দ্বিধা, ল’জ্জা, তার পাশাপাশি একটা অদ্ভুত ভালোলাগা, অসহায় মানুষগু’লোর জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ- সব মিলিয়ে গলা দিয়ে কথা ফুটছে না তাঁর।একান্ত নিজের একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখেন অনেকেই। কিন্তু আর পাঁচজনের স্বপ্নের থেকে অনেকখানি আলাদা ছিল মর’ুকানের স্বপ্ন। সেই কোন ছেলেবেলা ছেলে একটা বাড়ির স্বপ্ন তাঁর, কিন্তু নিজের জন্য নয়, তাঁর স্বপ্নের সেই বাড়ি হবে ঘরহারাদের জন্য, অনাথ হয়ে রাস্তায় ফুটপাথে পড়ে থাকে কোনও শিশুর জন্য, অসহায়ভাবে পড়ে থাকা গৃহহীন বুড়ো বাবা মায়ের জন্য।

খুব সীমিত সাধ্য নিয়েও এমন একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলেন মর’ুকান, চেয়েছিলেন সবার মাথার ওপরে একটা ছাদ থাকবে, চারদেওয়ালের উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত হবেনা গৃহহারা, অনাথ, আতুরেরাও। একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পাবে সবাই। বুকের মধ্যে এই একটা স্বপ্নকেই লালন করেছেন মর’ুকান। নিজের জীবনে চরম দারিদ্র্যের স’ঙ্গে লড়েও ৯০০০ অসহায় মানুষকে গড়ে দিয়েছেন ভালোবাসার আশ্রয়, একটুকরো’ ছাদের নীচে পরিবারের উষ্ণতা।ছোটো থেকেই ঘরহারা মর’ুকান। রাস্তার ধারে দিন কা’টাতে হয়েছে তাঁকে কখনো বা ঠাই মিলেছে অনাথ আশ্রমে। জীবন যদি শিকড়হীন হয়, তাহলে তা কতটা নিষ্ঠুর ‘হতে পারে তা নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন মর’ুকান।

এমনই একটা দিন, ভাত জোটে নি, খেতে না পেয়ে রাস্তায় শুয়ে কাঁদছিল মুরুকান, সেই সময় মাভুরিস নামে এক সমাজকর্মীর চোখে পড়ে সে। সেই ভদ্রলোকই তাঁকে উ’দ্ধার করে তুলে নিয়ে যান ডন বস্কো স্নেহভবনে। দীর্ঘ ৯ বছর মর’ুকান ছিল ওই ভদ্রলোকের আশ্রয়ে। মাভুরিসের প্রভাবে তাঁর ছন্নছাড়া জীবনে এক আশ্চর্য পরিবর্তন আসে। নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সে। চাইল্ড লাইনের কাজের পাশাপাশি টুকটাক আরও নানারকম কাজের সাথে যুক্ত হন তিনি। প্রথাগত পড়াশোনা যেভাবে না থাকায় অফিস জাতীয় কোনও কাজ কোনোদিনই করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু কাজের ছোট-বড় বিভাজন মানতেন না তিনি।

টাকা রোজগারের জন্য একসময় কী করেননি তিনি! মোট বয়েছেন, জোগাড়ের কাজ করেছেন- আর যেখান থেকে যা আয় করেছেন সমস্তটাই জমিয়ে রেখেছেন। শত প্রয়োজনেও নিজের জন্য একটা টাকা খরচ করতে হাত সরতো না তাঁর। তিনি জানতেন যেভাবেই হোক, তাঁকে একটা জমি কিনতে হবে। আশ্রয়হীন জীবনের যে কষ্ট তিনি ভোগ করেছেন, আর কোনও শিশু যেন তা না পায়! গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজ্যের বিভিন্ন শহর থেকে ঘরহীন শিশু ও বয়স্কদের তুলে এনে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে এই সংস্থা। বহুদিন ধরে লালিত মুরুকানের স্বপ্ন আকার পেয়েছে। এই কাজের সর্বেসর্বা মুরুকান হলেও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আরও কিছু সহৃদয় মানুষ। তাঁদের সকলের চেষ্টায় মাথার উপর ছাদ পেয়েছে বেশ কিছু অনাথ শিশু আর বৃ’দ্ধ। সবাই মিলে একটা বড়সড় পরিবার হয়ে ওঠার যে স্বপ্ন মুরুকান দেখেছিল, তার একটা অংশ পূরণ হইয়েছে বটে, কিন্তু থেমে থাকার মানুষ নন মুরুকান। উলটে আরও অনেক বেশি মানুষের মাথার উপর ছাদ গড়ে দেবার স্বপ্ন নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নতুন উদ্যমে।